চাচার মৃত্যুটা স্বাভাবিক না।

সুমনের গাড়ি এসে থামল পুরনো বাংলোটার সামনে। পাহারি রাস্তা থেকে অনেকটাই উপরে চারিদিকে ঘন জঙ্গলে ঘেরা একটি দোতলা বাংলো। আসার পথে ২-৪ জন পাহারি আদিবাসী ছাড়া কাউকে চোখে পরেনি গত ঘণ্টা ২ যাবত। চাচা অবসর নেয়ার পর কথুকে এই বাংলো তা মেনেজ করে এখানে এসে উঠেছে। কাপাতাই শহর থেকে দুরে রাঙ্গামাটি যাওয়ার পথে একটা ব্রিটিশ আমালের বাংলো। এর আগে বেশ খানিক বছর আগে একবার আসা হয়েছিল, চাচার সাথেই, সেবার থাকা হয় নি, কয়েক ঘণ্টার জন্য ছিল সে মাত্র। চাচার সাথে সম্পর্ক কখনই তেমন ঘনিস্ট ছিল না সুমনের। যদিও, বাবা, মা মারা যাওয়ার পর চাচাই একমাত্র অভিভাবক ছিলেন। তারপরও সবসময় একটা দূরত্ব বজায় রাখতেন তিনি। পরাশোনার কি অবস্থা? এই প্রস্ন বাদে তার সাথে আর কোন কথা হত কিনা তা এখন মনে করতে পারছে না সুমন। 

কালকে পুলিশর কল পায় সুমন, তারাই জানায় চাচার মৃত্যুর খবর। একজন কেয়ার টেকার ছিল, যে সকালে এসে চাচার মৃত দেহ পায়। হৃদ যন্ত্র বন্ধ হয়ে মৃত্যু। সুমনের হাতে কিছু কাজ ছিল তা শেষ করে পরদিন সকালে রওনা দেয় সে। এই লোকটার আর কেউ নেই তার মত, তাই অনিচ্ছা সত্তেও একমাত্র ভাতিজা হিসেবে তাকেই আসতে হয়। আসার পর, জানতে পারে তার নামেঈ এই বাংলোটা লিখে দিয়ে গেছেন চাচা। শুনে সামান্য অবাক হয়, এরপর ভালও লাগে সুমনের। সদ্য চাকরি পাওয়া এক যুবক, যে ঢাকায় ভাড়া থাকে, তার কাছে জীবনের প্রথম কোন সম্পতি পাওয়ার চিন্তাটা একটা ভাল লাগা তৈরি করে। সাথে সাথে সামান্য খারাপও লাগতে থাকে চাচার মৃত্যুতে। 

দরজার কপাট খুলে ভিতরে ডুকে সে। চাচার লাশ নিচতলার সোফাতে পাওয়া যায়। সোফাটা দরজার দিকে মুখ করা। সারা রাত অনেক ধূমপান করেছেন চাচা, এস ট্রে উপচে পরছে আধ খাওয়া সিগারেট। চাচা চরম নিঃসঙ্গ জিবনজাপন করতেন। বিয়ে করেননি কখনো। মাঝে মাঝে কল দিতেন, আসতে বলতেন, কিন্তু সংলাপ বেশি বড় হওয়ার আগেই রেখে দিত সুমন। রুমে, সুমনের ছোটবেলার বেশ কিছু ছবি বাধাই করা। তার কলেজ এর প্রথম দিন চাচা তার ক্যামেরা দিয়ে একটা ছবি তুলেছিলেন, সেটা বড় করে বাধানো, তার ছবি কোনটা তেই কোন ধুলোর ছিটে ফোটা নেই, অন্য সব গুলো জিনিসে ধুলোর আস্তর থাকলেও, তার গুলো প্রতিদিন মোছা হত। হাঠৎ, সুমনের বুকটা পাথরের মত ভারি হয়ে আসতে থাকে। মনোযোগ সরানোর জন্য দোতলায় যায় সুমন। দোতলার রুমের বাহিরে তার ছোট বেলার সাইকেল টা রাখা, সেটাতেও কোন ধুলো নেই। চাচার দোতলার রমটা তে তার আরও কিছু ছবি চোখে পরল, সাথে তার ছোট বেলার খেলনা ও দাবার বোর্ড। যেটা কিনা চাচা কাঠ দিয়ে নিজ হাতে বানিয়ে দিয়েছিলেন। একসময় প্রায় রাতে এই বোর্ডটাতে চাচার সাথে দাবা খেলা হত। বোর্ডটা খুবই পরিষ্কার, চাচা প্রতিদিন মুছতেন বোঝা যাচ্ছে। বোর্ডটা হাতে নিয়ে সুমন আর দারিয়ে থাকতে পারল না, সে চাচার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে কাদে নি, এখন সে কাদল, পাগলের মত কাদল। নিজেকে তার খুব অপরাধী মনে হতে থাকল। যে মানুষটা তাকে ছোট থেকে বড় করেছে, তার নিঃসঙ্গতার সময়, সে দূরে সরে গিয়েছে। চাচা সব সময় তার সকল ইমশোন লুকিয়ে রাখতে পছন্দ করতেন। কিন্ত এই মানুষটা, সারা জীবনী তাকে অনেক ভালবেসে গেছেন। সুমনের চোখে রাজ্জের ঘুম, সে খাটে কাদতে কাদতে ঘুমিয়ে পরল, যেন ঘুমঈ মুক্তি দিবে তাকে এই অপরাধ বোধ থেকে।

কিছু একটার শব্দে ঘুম ভাঙ্গল, কেউ একজন দরজার কড়া নাড়ছে, সে ঘড়ীতে দেখল মাঝ-রাত। 

কেউ একজন চাচার নাম ধরে ডাকছে, স্বরটা খুবই পরিচিত, সুমন লাফ দিয়ে উঠে বসল। স্বরটা তার নিজের, কিন্তু খুবই একঘেয়ে, প্রাণহীন একটা স্বর। এটা কিভাবে সম্ভব। সুমন দোতলার বেল্কনি দিয়ে নীচে তাকাল। যা দেখল, সেটা দেখার জন্য সে কখনই প্রস্তুত ছিল না। তার মত অবিকল অবয়বের কেউ একজন দারিয়ে আছে দরজার সামনে। তার উপস্থিতি টের পেয়ে, জিনিষটা উপরের দিকে তাকাল। এবার চাদের আলোয় পুরোপুরি জিনিষটাকে দেখতে পেল সুমন। তার মত দেখতে হলেও সামান্য কুঁজো হয়ে আছে জিনিসটি, কোন চার-পেয়ে জন্তু পিছনের দুই পায়ে দারালে দেখতে যেমন দেখায় আরকি। সুমনের দিকে তাকিয়ে একটি প্রাণহীন হাসি দিল সে। প্রাণহীন হাসি, তার দিকে তাকিয়ে তারি মত একজন হাসসে,

, সুমনের বিশ্বাস হতে চাচ্ছে না বেপারটা। সে জিনিশটির উদ্দেশে বলে উঠল, “কে !”। এবার জিনিসটি তার স্বর বদলিয়ে ফেলল চাচার স্বরে, “কেমন আসিস সুমন ?” …। কথা গুলো বলার সময় একটি বারের জন্যও প্রাণীটি মুখ নাড়াল না, সেই বিদঘুটে হাসি মুখে লাগান ওবস্থাতেই কথা গুলো ভেসে এল। 

সুমন বিদ্যুৎ গতিতে ঘরে ঢুকে বেল্কনির দরজা লাগিয়ে দিল। কি হচ্ছে এ গুলো তার সাথে। সে ঘামছে দর দর করে। নিচ হতে আবার ভেসে এল প্রাণহীন চাচার কণ্ঠ “বাবা তোমাকে কত দিন দেখি না, দরজাটা খুলে দেও।”  সুমনের গায়ে কাটা দিতে থাকল। মোবাইলে কোন নেটওয়ার্ক নেই। সে তারাতারি অন্য রুম গুলোর ছিটকিনি পরীক্ষা করতে লাগল। সব পরীক্ষা করে সে নিচ তলায় বড় ড্রয়িং রমে এসে দারাল, বাংলোর চারপাশে ছোটাছুটির শব্দ হচ্ছে, যেন কোনো বন্য প্রাণী তার শিকারের চারিপার্শে ঘুরছে। আবার চাচার কণ্ঠ শোনা গেল। এবার সামান্য আর্তনাদ মাখানো, “সুমন দরজা খোল, এভাবে যে চাচাকে ভুলে গেলি একটু খোঁজো নিলি না, তোকে আমার খুব মনে পড়ে’। ও

সুমন মনে মনে বলতে লাগল আমার চাচা কক্ষনঈ এভাবে কথা বলার লোক না। এবার দরাজার কড়া নারনো রুপান্তরিন হল জোড়ে জোড়ে ধাক্কাতে । জিনিশটি বেঙ্গারতক স্বরে বলতে শুরু করল “তোকে আমি এত কষ্ট করে মানুষ করলাম, কিন্তু শেষ বয়সে একবারের জন্যও আমাকে মনে করলি না, তুই একটা বেঈমান, নিজের চাচাকে এই জংগলে একা একা ফেলে রেখে দিলি। এখন এসেছিস আমার সব সম্পদ  ভোগ করতে, নিমকহারাম।” 

সুমনের হটাত রাগ হতে লাগল, মনে হল দরজা খুলে মুখোমুখি হয় জিনিষটার। এখন সে বুজতে পারছে যে তার চাচার মৃত্যু মোটেও স্বাভাবিক ছিল না, এবং কোন ভাবে এই জিনিসটি এর সাথে জড়িত। সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করল। সারা রাত ধরে চলল এর পুনরাবৃত্তি। কখনো মায়াবী স্বরে, কক্ষনবা ব্যাঙ্গারতক স্বরে, কখনো রাগান্বিত এক স্বর। 

সকালের সূর্য উঠার কিছু আগে বন্ধ হল সব। সুমন আবার কাঁদল। তার চাচা এই নিঃসঙ্গ জীবনের মধ্যে এমন এক ভয়াবহ কিছু একটার সাথে সংগ্রাম করে বেচে ছিল। একসময় হয়ত তার আবেগ, ধৈর্যের সীমা ভেঙ্গে দেয়। খুলে দেয় সে দরজা। 

সকাল হওয়ার সাথে সাথে সুমন বাংলো থেকে বের হয়ে গাড়িতে উঠল। তার ভিতর কোন একটা কিছু বলে উঠতে লাগল যত তারাতারি সম্ভব এখান থেকে দূরে চলে যেতে। সে গাড়িতে উঠে টান দিল, যত দ্রুত সম্ভব এখান থেকে চলে যেতে হবে। 

সুমন যত দূরে যাচ্ছে ততই তার অপরাধ বোধ বাড়ছে। তার চাচা একা একা নিঃসঙ্গ ভাবে প্রান হারাল, কিছুই করতে পারল না সে। ব্রেক চাপল সে, সিধান্ত নিল ফিরে যাবে সে।  এই অপরাধ বোধ নিয়ে সে বেচে থাকতে পারবে না। 

বাংলো তে ফিরে এসে দৌড়ে চাচার আলমারি টা খুলল, সে জানে চাচা এখানে একটা পুরনো হান্টিং রাইফেল রাখত। এক কাপ চা বানাল সুমন। সে চাচার নিচ তলার সোফাটা তে বসল রাইফেল হাতে। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ভাবতে লাগল, সুমন সন্ধ্যা হতে আর বেশি দেরি নেই। আজ রাতে দরজা খোলা রাখবে সে। 

(এটা আমার লেখা প্রথম গল্প, যেটা এখানে দিতেছি, আমি আমেরিকান স্কিন ওয়াকার “skin walker” ফ্লক লোর থেকে ইন্সপায়রেসন নিসি গল্পের জন্য।)

    


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *